সন্দ্বীপের প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ ব্যবহারের কিছু পরামর্শ
প্রকাশিত : ২১:২০, ২৮ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ২০:৩২, ২৯ আগস্ট ২০১৮
প্রবাসীদের দ্বারা প্রেরিত অর্থ ব্যাক্তি, সমাজ এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির উপর ক্রমাগতভাবে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির উপর এর প্রভাব অত্যন্ত দৃশ্যমান। জনসংখ্যার ঘনত্বের বিবেচনায় দশমতম এ দেশে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের ভূমিকা এক কথায় অকল্পনীয়। প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থ যেমন পারিবারিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ নিশ্চিত করেছে তেমনি বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের চলতি হিসাব শক্তিশালী করে দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদও মজবুত করছে। সরকার প্রবাসীদের এ অর্জিত অর্থের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজগুলো সমাপ্ত করে অর্থনীতির চাকাকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অধিকন্তু বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভের অর্থ আমাদের ঋণ পরিশোধের সামর্থ বৃদ্ধি করছে বলে বিদেশী ঋণ নেয়ার পথও সুগম হচ্ছে।
বাংলাদেশীদের কর্তৃক দেশে প্রেরিত অর্থের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮০ সালে যেখানে রেমিটেন্সের পরিমাণ মাত্র ০.৩৮১ বিলিয়ন ইউএস ডলার ছিল তা ২০১৫ সালে ১৫.৩১ ইউএস ডলারে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ১৯৮০ সালে রেমিটেন্স জিডিপি এর শতকরা ১.৯৯ ছিল, যা ২০১৫ সালের শেষে শতকরা ১৪.৫৬ ভাগে দাঁড়িয়েছে। রেমিটেন্সের এ পরিসংখ্যান অর্থনীতিতে এর অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা প্রতিভাত করছে। বর্তমানে বিদেশী অনুদান এবং বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মুখে বিদেশ হতে আগত ক্রমবর্ধণশীল এ অর্থ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে অনন্য ভূমিকা রাখছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল রেমিটেন্সের এ অন্তপ্রবাহে ভূমিকা রাখলেও তিন হাজার বছরের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের অধিকারী সন্দ্বীপ উপজেলা এ ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে দেশের অর্থনীতিকে সহযোগীতা করছে। এ সহযোগীতা প্রাচীনকাল থেকে প্রবাহমান এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত তা বিদ্যমান। সন্দ্বীপের লোকজনের নাবিক হিসেবে সুখ্যাতি ছিল বলে, সুপ্রাচীন কাল থেকে তাঁরা বিভিন্ন নৌযানে বিভিন্ন পদমর্যাদায় চাকরি করত। এ সুবাদে তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় কাজের প্রয়োজনে যায় এবং অনেক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ফলশ্রুতিতে আবহমান কাল থেকে বিদেশে চাকুরী করে তাঁরা আত্মীয়স্বজনদের এবং সামাজিক কাজের জন্য দেশে রেমিটেন্স পাঠাত- যা বর্তমান সময় পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, রেমিটেন্স প্রবাসীর পরিবারের আয় বৃদ্ধি করে, জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করে, দারিদ্র দূরীকরণ করে ও সঞ্চয়, বিনিয়োগসহ দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এখন কথা হচ্ছে, আবহমান কাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রবাসী সন্দ্বীপীদের দ্বারা প্রেরিত রেমিটেন্স এ অঞল এবং সন্দ্বীপে বসবাসকারী মানুষের উন্নয়ন সাধনে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছে।
অর্জন হিসেবে প্রবাসীদের পরিবারগুলো অর্থনৈতিকভাবে ভালো আছে এবং স্বাভাবিক উন্নয়নের ধারায় তাঁরা সমান ভাবে অগ্রসরমান। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে। প্রবাসীদের পরিবারগুলো চমৎকার বাসস্থানে সন্দ্বীপ অথবা সন্দ্বীপের বাইরে বাস করছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ এবং মন্দিরে দান করছে, নিজেদের সন্তানদের শিক্ষিত করছে, আধুনিক ভোগ্য সামগ্রী ভোগ সহ কখনো কখনো স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশগ্রহন করে সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
তবে ভাববার বিষয় হল, এ বিপুল বৈদেশিক অর্থ সন্দ্বীপে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আশাপ্রদ কোন ফল দেখাতে পারেনি। এক সময় ছিল যখন লবণ ও জাহাজের ব্যবসা সন্দ্বীপে জনপ্রিয় ছিল। রপ্তানির জন্য জাহাজ ভর্তি লবণ প্রায়শ চোখে পড়ত এবং স্থানীয় চাহিদার সাথে সাথে রফতানির জন্যও জাহাজ বানানো হত। কিন্তু সন্দ্বীপের এই শিল্পগুলোর অস্তিত্ব এখন আর নেই বললেই চলে।
শিক্ষায় বিনিয়োগর ক্ষেত্রে সন্দ্বীপ মোটামুটি মাঝামাঝি অবস্থানে আছে। ৫টি কলেজ (১৯৭২ সালের পরে ৪টি), আনুমানিক ২৮টি উচ্চবিদ্যালয় (৫টি ১৯৭২ সাল পরবর্তী), ৯টি মাদ্রাসা, ১৪৯টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, এবং ৪৭টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সন্দ্বীপে প্রতিষ্ঠিত এবং সন্দ্বীপে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে। সন্দ্বীপে বয়স্ক শিক্ষার হারও সম্মানজনক, আনুমানিক প্রায় ৫২ শতাংশ। তবে কথা হল শিক্ষাটা মান সম্পন্ন হচ্ছে কিনা। বিশেষত ইংরেজীতে এবং কম্পিউটার শিক্ষার ক্ষেত্রে সন্দ্বীপের মান জাতীয় শিক্ষার থেকে পেছনে। এখানে আর একটি সীমাবদ্ধতার কথা না বললেই নয়, তা হল কারিগরি শিক্ষা। কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আত্মকর্মসংস্থান এবং বিদেশে দক্ষ মানবসম্পদ পাঠানোর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত। দূর্ভাগ্য যে, এ সমস্ত অর্জনের ক্ষেত্রে বৈদেশিক অর্থের ভূমিকা নেই বললেই চলে। সন্দ্বীপের নতুন স্কুল ও কলেজগুলো সন্দ্বীপের শিল্পপতি বা ধনীক শ্রেণীর হাত ধরে হয়েছে, প্রবাসীদের বা তাঁদের অর্থ দ্বারা নয়।
স্বাস্থ্যগত সুবিধার ক্ষেত্রে, সঠিক চিকিৎসা, চিকিৎসার জন্য রোগ নির্ণয় ইত্যাদির ক্ষেত্রে সন্দ্বীপ বাসীগণ এখনও চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরের উপর নির্ভরশীল। বিদেশ থেকে আগত অর্থ এক্ষেত্রে বিশেষত মানসম্পন্ন হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্র তৈরীতে বিশেষ অবদান রাখতে পারত। বর্তমান স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহকে মানসম্মত করার ক্ষেত্রেও বিদেশ হতে পাঠানো এ অর্থ ব্যবহার করা যেতে পারত।
রপ্তানিমুখী সন্দ্বীপ এখন আস্তে আস্তে আমদানি নির্ভর এলাকায় পরিণত হচ্ছে। সন্দ্বীপের যুবক শ্রেণীর কর্মবিমুখ সংস্কৃতি এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও দায়ী। বিগত দিনে খাদ্য উৎপাদন, শাক-সবজি এবং ফল চাষে বা মাছ ধরায় সন্দ্বীপবাসী ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে লোকজন ব্যস্ত সময় কাটাত। কিন্তু বর্তমানে প্রবাসী পরিবারের সন্দ্বীপে অবস্থানকারী সদস্যবর্গ এসব কাজে আগ্রহী নয়। তারা বিদেশ থেকে আগত অর্থের উপর নির্ভরশীল থেকে অলস সময় অতিবাহিত করে। এমনও দেখা যায় যে, প্রবাসী পরিবারের সদস্যবর্গ চায়ের টেবিলে বসে চায়ের কাপে ঝড় তোলে এবং উৎপাদনশীল কাজের পরিবর্তে ধ্বংসাত্বক রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে বেশীরভাগ ভোজ্যপণ্য এখন সন্দ্বীপে আমদানি করতে হয়।
এ প্রেক্ষিতে বিদেশ হতে আগত বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারের মাধ্যমে সন্দ্বীপের উন্নয়ন অর্জনের জন্য কিছু পরামর্শ নিন্মে তুলে ধরা হল।
১.ব্যাংক অর্থনীতির চালিকা শক্তি। সন্দ্বীপে সরকারী, বেসরকারী এবং বিশেষায়িত ব্যাংক মিলে প্রায় ৭টি ব্যাংকের শাখা রয়েছে। এ ব্যাংকগুলোতে কর্মরত অফিসারগণ বিনিয়োগজ্ঞানে সমৃদ্ধ। তাঁরা বিদেশীদের প্রেরিত অর্থের একটি অংশ সন্দ্বীপে বিনিয়োগের উদ্যোগ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় কিছু শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিক্ষেত্র চিহ্নিত করে সম্ভাব্য কিছু উদ্যোক্তাগণকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বিনিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশা হল ব্যাংকের শাখাসমূহ শ্রমঘন ও দারিদ্র দূরীকরণ উপযোগী ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পসহ কৃষিখাতকে অগ্রাধিকার প্রদান করবে।
২.শিল্পখাতসমূহ যেমন- লবণ, জাহাজ, মাছ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, কোল্ড স্টোরেজ সহ ইত্যাদি সেবা খাতের বিশাল সুযোগ রয়েছে সন্দ্বীপে। শিক্ষা, চিকিৎসা, ট্যুরিজম ও হোটেল ব্যবসার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে এ দ্বীপাঞ্চলে। প্রবাসীগণ এবং ব্যবসায়ীগণ এ সব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে।
৩.প্রবাসীদের নিকট আত্মীয়গণ সন্দ্বীপে রয়েছে। প্রবাসীগণ দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় তাঁদের মধ্যে বিনিয়োগ সংক্রান্ত জ্ঞান হওয়া স্বাভাবিক। অধিকন্তু বিদেশে কোন দ্রব্যের চাহিদা রয়েছে তা তাঁদের জানার কথা। প্রবাসীগণ তাঁদের আত্মীয়স্বজনদেরকে তাঁদের অর্জিত অর্থ ও জ্ঞান দিয়ে সন্দ্বীপে বিভিন্ন উৎপাদনশীর প্রকল্প গ্রহণে সহায়তা করতে পারেন।
৪.সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী শিল্প উদ্যোক্তাগণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুনামের ও প্রভাবের সাথে ব্যবসা করছে। এ ব্যবসায়ীগণ তাঁদের প্রধান শিল্পের কাঁচামালসহ ছোটখাট সরজ্ঞাম তৈরীর কারখানা সন্দ্বীপে স্থাপন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সস্তা শ্রম, কাঁচামালের সহজলভ্যতা এবং সন্দ্বীপের নিকটবর্তী চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা গ্রহণ করে, সন্দ্বীপের ব্যবসায়ীগণ লাভবান হতে পারেন।
৫.সন্দ্বীপের বহির্গমন ইচ্ছুক যুবক ও যুবতীগণ কারিগরী শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদেরকে দেশের বাইরে কাজের জন্য অধিকতর যোগ্য করে তুলতে পারেন। এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সন্দ্বীপে সরকারী অথবা বেসরকারী উদ্যোগে কয়েকটি কারিগরি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রবাসীগণও এ ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, একজন বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগের পূর্বশর্ত হচ্ছে কাঙ্খিত পরিবেশ। ভালো পরিকাঠামো, উৎপাদিত দ্রব্যের বাজার, উন্নত আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি ব্যয়ের তুলনায় উপযুক্ত লাভে উপযুক্ত দ্রব্য বিক্রয় কাঙ্খিত পরিবেশের নিয়ামক। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন সন্দ্বীপে বিনিয়োগের এ কাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলে, প্রবাসীগণ এবং সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী শিল্পপতিগণ শুধুমাত্র দেশ প্রেমের টানে সন্দ্বীপে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। বিশেষ করে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন সন্দ্বীপে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টির অতি আবশ্যকীয় এক পূর্বশর্ত। দেশের মূল ভূখন্ডের সাথে প্রস্তাবিত সড়ক যোগাযোগের বাস্তবায়ন, সাপ্তাহিক দুই/এক দিন আকাশ পথে যোগাযোগের ব্যবস্থা এবং উন্নত, নিরাপদ ও দ্রুত গতিসম্পন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে যাতায়াত ব্যবস্থার বর্তমান দূরাবস্থা দূরীকরণ করে সন্দ্বীপে বিনিয়োগের কাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব।
লেখক পরিচিতি: অধ্যাপক ও পরিচালক (গ.উ.ক.), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।